বিশ্ব কিডনি দিবস, ২০২৫ : কিডনি সুস্থ রাখতে আগেভাগে সচেতন হোন

 


ভূমিকা

কিডনি মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি অপসারণ করে রক্তকে পরিশোধিত রাখে। তবে বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিক মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে, অনেকেই অনিয়মিত জীবনধারার কারণে অজান্তেই কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কিডনি রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রতিবছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পালিত হয় বিশ্ব কিডনি দিবস। ২০২৫ সালের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য "Are Your Kidneys OK? Detect Early, Protect Kidney Health"—অর্থাৎ, কিডনি সুস্থ আছে কি না তা আগেভাগে নির্ণয় করুন এবং কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষা করুন।

কিডনির গঠন ও কার্যকারিতা

মানবদেহে দুটি কিডনি থাকে, যা পিঠের নিচের অংশে মেরুদণ্ডের দুপাশে অবস্থিত। প্রতিটি কিডনি প্রায় ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা, যা এক প্রকার ফিল্টারের মতো কাজ করে। কিডনির প্রধান কাজ হলো—

  1. বর্জ্য ও অতিরিক্ত তরল অপসারণ: প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে দেওয়া।
  2. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: শরীরে লবণ ও পানির ভারসাম্য রক্ষা করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
  3. রক্ত তৈরি: ইরিথ্রোপোয়েটিন (EPO) হরমোন উৎপাদনের মাধ্যমে লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়তা করা।
  4. অ্যাসিড-বেইস ভারসাম্য বজায় রাখা: দেহের পিএইচ লেভেল নিয়ন্ত্রণ করা।

বিশ্ব কিডনি দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বিশ্ব কিডনি দিবসের মূল লক্ষ্য হলো—কিডনি রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারার প্রচার করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্দেশ্য হলো:

  • কিডনি রোগের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
  • ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া।
  • সময়মতো কিডনি পরীক্ষা করানোর অভ্যাস গড়ে তোলা।
  • কিডনি রোগের চিকিৎসা ও ডায়ালাইসিস সুবিধাগুলোর ব্যাপারে প্রচার চালানো।

কিডনি রোগের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ

কিডনি রোগের অন্যতম কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। কিছু সাধারণ কারণ নিচে তুলে ধরা হলো—

১. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগের প্রধান কারণ। ডায়াবেটিসের ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে। অন্যদিকে, উচ্চ রক্তচাপ কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

২. পানিশূন্যতা ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস

অতিরিক্ত লবণ, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয় ইত্যাদি গ্রহণ করলে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে কিডনিতে পাথর জমার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৩. অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ সেবন

অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs), অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড বা অন্যান্য কেমিক্যালযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে পারে।

৪. ধূমপান ও মদ্যপান

অতিরিক্ত ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ কিডনির রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়, যার ফলে কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।

৫. বংশগত কারণ

অনেক সময় জেনেটিক কারণে কিডনি রোগ হতে পারে। পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (PKD) নামক এক ধরনের বংশগত রোগে কিডনিতে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়, যা পরবর্তী সময়ে কিডনি বিকলের কারণ হতে পারে।

কিডনি রোগের লক্ষণ

কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে না। তবে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত—

  • হাত-পা বা চোখের নিচে ফোলা (Edema)
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্রস্রাবে ফেনা, রক্ত, দুর্গন্ধ থাকা
  • অবিরাম ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা ও ওজন কমে যাওয়া
  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকা
  • পিঠ বা কোমরের নিচের অংশে ব্যথা
  • চুলকানি, বমি ভাব ও শ্বাসকষ্ট

কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়

কিডনির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমাদের সচেতন জীবনধারা অনুসরণ করা জরুরি। কিছু কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হলো—

১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

  • কম লবণ, চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল খান।
  • চর্বিযুক্ত লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে ফেলুন।

২. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

  • প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা কিডনির জন্য ভালো।
  • শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে গরম আবহাওয়ায় বেশি পানি পান করুন।

৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন

  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইক্লিং বা ব্যায়াম করুন।
  • স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে রাখুন, কারণ অতিরিক্ত ওজন কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন

  • ধূমপান বন্ধ করলে কিডনির রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে।
  • অ্যালকোহল গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।

৫. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন

  • প্রতি ছয় মাস বা এক বছরে একবার কিডনি ফাংশন টেস্ট (Blood Urea, Serum Creatinine, eGFR) করানো উচিত।
  • উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

উপসংহার

কিডনি মানবদেহের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের কারণে কিডনি রোগের ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ব কিডনি দিবসের মূল বার্তা হলো—"Are Your Kidneys OK?", অর্থাৎ কিডনির স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমরা কতটা সচেতন? আগেভাগে কিডনি পরীক্ষা করিয়ে নিলে মারাত্মক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই আমাদের উচিত স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা এবং কিডনি পরীক্ষা করিয়ে রাখা। একমাত্র সচেতনতাই পারে কিডনি রোগের ভয়াবহতা রোধ করতে। বিশ্ব কিডনি দিবসে আসুন আমরা সবাই কিডনি রোগ প্রতিরোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

Comments

Popular posts from this blog

ডাক্তারি—স্বপ্ন না আত্মত্যাগ?

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫: “জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত”

কাটাছেঁড়া ছাড়াই কিডনি পাথর ভাঙতে অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি (ESWL)