আল্লাহকে কেউ সৃষ্টি করে নি : ইসলামিক দর্শন বহির্ভূত যৌক্তিকতা

আল্লাহর সৃষ্টির প্রশ্নটি একান্তই ইসলামী ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দর্শন, দার্শনিক তত্ত্ব এবং যুক্তির আলোচনারও বিষয়। আল্লাহ নিজে সৃষ্ট নয়, তিনি অমর, অস্থির এবং সবকিছুর উপরে অবস্থান করেন। ইসলামি দর্শন অনুযায়ী, আল্লাহ একমাত্র সত্তা, যাকে সৃষ্টির প্রয়োজন নেই, কারণ তিনি পরিপূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল, এবং তার অস্তিত্ব একান্তই স্বতঃসিদ্ধ। এই ধারণাটি ইসলামী ভাবনায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে এটি প্রাচীন এবং আধুনিক দার্শনিক চিন্তাধারায়ও বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমি আল্লাহর সৃষ্টিহীনতার ধারণাকে বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন দার্শনিকের তত্ত্ব তুলে ধরব।

১. আরিস্টটলের "প্রথম কারণ" তত্ত্ব

প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক আরিস্টটল তাঁর মেটাফিজিক্স গ্রন্থে "প্রথম কারণ" বা "প্রাথমিক সৃষ্টিকর্তা" তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তার মতে, পৃথিবীতে এবং পুরো বিশ্বজগতের সব কিছু কিছু না কিছু কারণের মাধ্যমে ঘটে। কিন্তু যদি এই কারণগুলির একটি অবিরাম (infinite) চক্র থাকে, তবে এর কোনো শেষ হবে না, যা অসঙ্গত। এই সমস্যার সমাধান হিসাবে তিনি একটি "প্রথম কারণ" বা "অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব"-এর কথা বলেছেন, যা কোনো সৃষ্টির প্রয়োজন নেই, এবং যা নিজ থেকে অস্তিত্বশীল। এই "প্রথম কারণ" বা সৃষ্টিহীন সত্তা একটি প্রাথমিক শর্তে অস্তিত্ব ধারণ করে এবং তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কিছু প্রয়োজন নেই।

আরিস্টটলের এই তত্ত্ব আল্লাহর সৃষ্টিহীনতার ধারণার সাথে পুরোপুরি মেলে, কারণ আল্লাহও কোনো বাহ্যিক কারণ বা সৃষ্টির মাধ্যমে আসেন না, বরং তিনি চিরকালীন, আত্মনির্ভরশীল, এবং অপরিহার্য সত্তা।

রেফারেন্স: Aristotle. Metaphysics.

২. ডেসকার্তেসের আত্মনির্ভরশীল অস্তিত্ব

রেনé ডেসকার্তেস, যিনি "Cogito, ergo sum" (আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি) ধারণার জন্য বিখ্যাত, তিনি বলেছিলেন যে আমাদের অস্তিত্বের জন্য একটি অদ্বিতীয় কারণ থাকা উচিত, যা আত্মনির্ভরশীল এবং স্বতঃসিদ্ধ। তার মতে, যদি কিছুই সৃষ্ট হতে না পারে, তবে তার অস্তিত্ব এক ভিন্ন প্রকৃতির হবে, যা সৃষ্টির বাইরে থাকবে।

ডেসকার্তেসের চিন্তা অনুযায়ী, আল্লাহ বা "অপারিষ্কৃত সত্তা" কোনো সৃষ্টির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। তিনি সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল, এবং তার অস্তিত্ব কোনো বাহ্যিক সৃষ্টির উপর নির্ভরশীল নয়।

রেফারেন্স: Descartes, René. Meditations on First Philosophy.

৩. স্পিনোজা এবং ঈশ্বরের আত্মনির্ভরশীলতা

বারুচ স্পিনোজা ছিলেন একজন প্যানথিস্ট দার্শনিক। তার মতে, ঈশ্বর এবং প্রকৃতি এক এবং অভিন্ন। তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর কোনো সৃষ্টির মাধ্যমে আসেন না, বরং ঈশ্বর তার অস্তিত্বের জন্য কোনো বাহ্যিক কারণে নির্ভরশীল নন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সর্বজনীন, আত্মনির্ভরশীল এবং অমর, যা কোনো সময় বা স্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।

স্পিনোজার মতে, ঈশ্বর যদি সৃষ্টির উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতেন, তবে তিনি তার অস্তিত্বের সাথে অসঙ্গত হতেন। কারণ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখে না, এবং তার অস্তিত্ব নিজের মধ্যে পূর্ণ।

রেফারেন্স: Spinoza, Baruch. Ethics.

৪. হেগেল এবং অবিনশী আত্মা

জার্মান দার্শনিক জর্জ উইলহেম ফ্রিডরিখ হেগেল ঈশ্বর বা আত্মার অস্তিত্বকে একটি চলমান, অবিনশী প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। হেগেল বলেন, ঈশ্বর কোনো বাহ্যিক সৃষ্টির মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না, বরং তিনি নিজের মধ্যে পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল এবং অবিনশী সত্তা।

হেগেলের চিন্তা অনুযায়ী, ঈশ্বর বা আত্মার অস্তিত্ব কোনো বাহ্যিক শক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয় না, বরং ঈশ্বর তার নিজ অস্তিত্বে পূর্ণ, এবং সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা তার অস্তিত্বের বাইরে চলে যায়।

রেফারেন্স: Hegel, Georg Wilhelm Friedrich. The Science of Logic.

৫. জন লকের প্রাথমিক অস্তিত্ব

জন লক, একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, মানব অস্তিত্বের প্রথম উৎস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তার মতে, অস্তিত্বের শর্তাবলী নির্ধারণকারী একটি "প্রাথমিক অস্তিত্ব" থাকতে হবে, যা কেবল অস্তিত্ব ধারণ করে এবং সৃষ্টির জন্য কোনো বাহ্যিক শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। লকের এই তত্ত্বও আল্লাহর সৃষ্টিহীনতার ধারণাকে সমর্থন করে, কারণ আল্লাহ কোনো নির্দিষ্ট সময় বা পরিস্থিতির সাথে যুক্ত নন এবং তার অস্তিত্ব কেবল নিজস্ব।

রেফারেন্স: Locke, John. Essay Concerning Human Understanding.

উপসংহার:

উপরোক্ত দার্শনিকদের তত্ত্ব অনুসারে, আল্লাহ বা ঈশ্বর কখনো সৃষ্ট হতে পারেন না। তারা সবাই এমন এক সত্তার কথা বলেছেন যিনি সৃষ্টিহীন, অপরিহার্য এবং স্বতঃসিদ্ধ। আল্লাহও এই তত্ত্বের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ তিনি নিজেই একটি অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব, যিনি পরিপূর্ণ, চিরকালীন এবং আত্মনির্ভরশীল। ইসলামিক দর্শন এবং প্রাচীন ও আধুনিক দার্শনিক চিন্তাধারা মিলিতভাবে আল্লাহর সৃষ্টিহীনতার ধারণাকে আরও দৃঢ় করে।

এভাবেই, আল্লাহর সৃষ্টির প্রশ্নে যে কোনো দার্শনিক চিন্তা বা যুক্তির মাধ্যমে তার সৃষ্টিহীনতার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

ডাক্তারি—স্বপ্ন না আত্মত্যাগ?

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫: “জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত”

RENAL STONE & ITS MODERN TREATMENT( কিডনীর পাথর ও তার আধুনিক চিকিৎসা )